দোষ-গুনের মিশ্রণ একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য। একারণে যেকোন পরিস্থিতি বা ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখায় মানুষ। দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ বা ভয় এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, মানুষ মাত্রই দুঃশ্চিন্তা করবে, ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অ্যাংজাইটি ডিজর্ডার বা উদ্বেগ জনিত রোগগুলোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দু:শ্চিন্তা, উদ্বেগ বা ভয়ের সৃষ্টি হয় যা আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করে।
এসব রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, স্থান এড়িয়ে চলার প্রবনতা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে রোগী তার দুঃশ্চিন্তা বা উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করে। তার এই এড়িয়ে চলা বা বিপদের আশঙ্কা এত অতিরিক্ত পরিমানে হয় যা একজন চিকিৎসক সহজেই শনাক্ত করতে পারে। চিকিৎসা না করলে এই রোগ স্থায়ী আকার ধারণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় অ্যাংজাইটি ডিজর্ডার।
নানা ধরনের অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার রয়েছে। প্যানিক ডিজঅর্ডার (Panic Disorder) তাদের একটি।
প্যানিক ডিজঅর্ডার (Panic Disorder):
মানুষের দুঃশ্চিন্তা হয় মনে আর তা প্রকাশ পায় শরীরে। আমরা অনেকেই এগুলোকে শারীরিক রোগের লক্ষণ ভেবে ভুল করি। উদ্বেগ জনিত রোগ বা প্যানিক ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই এর লক্ষণ গুলো জানা দরকার। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ডায়াগনষ্টিক এ্যান্ড এস্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল ফর মেন্টাল ডিজঅর্ডার (ডি এস এম-৫) প্যানিক ডিজঅর্ডার নির্ণয়ের জন্য কিছু লক্ষণের কথা বলা হয়েছে:
বার বার অপ্রত্যাশিত ভাবে প্যানিক অ্যাটাক দেখা যায়। প্যানিক অ্যাটাকের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কিছু সময়ের জন্য তীব্র ভয় এবং অস্বস্তি তৈরী হয় যা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেড়ে যায়। এসময়ে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়ঃ
√ বুক ধড়ফড় করা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি বা হৃদপিন্ডের গতি দ্রুততর হয়।
√ ঘাম হওয়া।
√ শরীরে কাঁপুনি হওয়া।
√ শ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব করা।
√ দম বন্ধ হয়ে আসা।
√ বুক ব্যথা বা চাপ লাগা অনুভব করা।
√ বমি বমি ভাব বা পেটের মধ্যে যন্ত্রনা/অস্বস্তি বোধ করা।
√ চারদিকের সবকিছুই ঘুরতে থাকে, অস্থিরভাব।
√ চিন্তা এবং চলাফেরার প্রতি পর্যাপ্ত পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ না থাকা অথবা মুর্ছা যাওয়া।
√ শীত অথবা গরম অনুভব করা।
√ প্যারেস্থিসিয়াস (অবশ বা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করা)।
√ ডিরিয়ালাইজেশন (অবাস্তব অনুভূতি) অথবা ডিপার্সোনালাইজেশন (নিজের মধ্যে নেই, নিজের সাথে আলাদা হয়ে থাকে)।
√ নিয়ন্ত্রণহীনতার ভয় বা উত্তেজিত হওয়া।
√ মৃত্যুভয়।
ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এই রোগ বেশী দেখা যায়। ১৪ বছরের আগে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ বেড়ে যেতে পারে। যদিও শৈশবে প্যানিক অ্যাটাক খুব কমই হতে দেখা যায় তবে ভীতিকর অনুভূতি তার শৈশবের আগেই তৈরী হয়ে যায়। এই রোগটি অনেক সময় স্থায়ী ভাবে থেকে যায় সহজে ভাল হয় না এবং অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন এবং বাইপোলার মুভডিজঅর্ডার এর সাথে সহ রোগ হিসেবে থাকে।
অনেকে বিশ্বাস করেন যে, প্যানিক অ্যাটাক এর কারনে তার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হবে। প্যানিক ব্রেন টিউমার এর একটা উপসর্গ এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে যার ফলে দ্রুতই মরে যাওয়ার ভয় কাজ করে রোগীদের মধ্যে।
এসব রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা এমনকি আত্মহত্যার প্রচেষ্টাও দেখা যায়। রোগের কারনে ব্যক্তির সামাজিক, পেশাগত বা শারীরিক অনেক অক্ষমতা দেখা যায়। ডাক্তার বা চিকিৎসার কারনে প্রচুর টাকা খরচ হয়।
শৈশবে যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, নেতিবাচক আবেগীয় অভিজ্ঞতা সহজেই দুঃশ্চিন্তা করার প্রবনতা, বংশগত প্রভাব এমন অনেক বিষয় এই রোগের পিছনে জড়িত।
তাই আর ভয় নয়; ভয়কে জয় করা দরকার এখই। এজন্য সন্তান লালন-পালন পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া বা অন্যান্য মানসিক বিষয় সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান রাখা এখন সময়ের দাবী। অন্যথায়, আমাদের অজ্ঞতা প্যানিকসহ এ ধরনের মানসিক রোগীতে পরিণত করবে।