কি আশ্চর্য কথা ! এতদিন ধরে পেট বড় হচ্ছে। পেটের ভেতরে বাচ্চা নড়াচড়া করে। আর এখন ডাক্তার বলে কি না, বাচ্চা নেই !
উনারা এবার এলেন গাইনী ডাক্তারের কাছে।
'ছোল তাল্যে গেল কুঠি?'
পেট দেখলাম। সাত মাসের পেটের মতই মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয়, পেটের চামড়ার নীচে রক্তনালীগুলো দেখলেও মনে হয় এটা প্রেগন্যান্ট ইউটেরাসই বটে। রোগীর বসা, নড়াচড়া সবই প্রেগন্যান্ট নারীদের মতই। এবার বেডে শুইয়ে দেখলাম। জরায়ুর উপরের অংশ (ফান্ডাস) ফিল করা যাচ্ছেনা বটে, কিন্তু নাভীর নীচে হাত দেয়ার সাথে সাথে রোগী এমনভাবে পেট ফুলিয়ে ফেলছে যে, টেনশ অ্যাবডোমেন ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শোয়ার পরেও পেটটা এত সুন্দর ২৮ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট পেটের মত হয়ে আছে যে, এটাকে ফলস বা ফ্যান্টম প্রেগন্যান্সী ভাবতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।
রোগীর চোখেমুখে তখনও সন্দেহের ছাপ।
'দেখি, ঠাকুর কি করে !'
ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগন্যান্সী ( Pseudocyesis ), বিচিত্র প্রকৃতির বিচিত্র খেলার উদাহরণ যেন এটি। অত্যন্ত রেয়ার (rare) একটি কন্ডিশন যেটি নিয়ে এখনও চিন্তার অবকাশ আছে । কেন ঘটে এটি কিংবা কেনই বা এটি প্রেগন্যান্সীর সকল উপসর্গ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে? অনেকেই মনে করেন, কারণটা শারীরিক, আবার কেউ মনে করেন মানসিক, অল্প সংখ্যক মনে করেন এটি মস্তিষ্কের রাসায়নিক অসামঞ্জস্যতার ফল মাত্র।
তবে মূলত: দেখা যায়, কিছু সামাজিক ইস্যু এ রোগের জন্য দায়ী। যেমন: বারবার গর্ভপাত হওয়া বিশেষত: মিসড অ্যাবরশন,দীর্ঘদিনের বন্ধ্যত্ব, সন্তান মারা যাওয়া বিশেষত: বারবার, একটিও জীবিত সন্তান না থাকা ইত্যাদি। এ ইস্যু গুলো রোগীর মনের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষত সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে এর সাথে যোগ হয় সামাজিক চাপ। 'বাচ্চা হচ্ছেনা কেন?', ' আর কতদিন লাগবে?', 'বিয়ের বয়স তো কম হল না !', 'ছেলে না থাকলে কি ঘর সাজে !' ,'নতুন বউ ছাড়া এই বউ দিয়ে আর হবেনা', 'আর ছ'মাস দেখব, তারপর আর না' ইত্যাদি ইত্যাদি।
ক্ষতগুলো যেন গভীর থেকে গভীরতর হয়। এ ক্ষত সারাতেই গর্ভবতী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা তার ভেতরে কাজ করে। আর তার ফলস্রুতিতেই তার মস্তিষ্ক একসময় ভাবতে শুরু করে যে সে আসলেই গর্ভবতী বা প্রেগন্যান্ট। মূলত: আমরা যখন মনে প্রানে কিছু প্রত্যাশা করি তখন অবশ্যই ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস সিগন্যাল পাঠায় তার নিয়ন্ত্রিত অঙ্গগুলি যেমন পিটুইটারি, গোনাড, এড্রেনাল গ্ল্যান্ড ইত্যাদির কাছে। ফলে নিউরো এন্ডোক্রাইন মিথোস্ক্রিয়া ঘটে। এর ফলোশ্রুতিতেই শারিরিক এবং আবেগীয় পরিবর্তন গুলি ঘটতে থাকে একের পর এক।
অন্যান্য গর্ভবতী নারীদের মতই সকল প্রেগন্যান্সী উপসর্গ দেখা দেয় তার । পিরিয়ড বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে মর্নিং সিকনেস, পেট বড় হওয়া, মোটা হওয়া, স্তনসহ চামড়া ও শরীরের অন্যান্য অংশের শারীরিক পরিবর্তন, খাওয়ার অরুচি, ঘন ঘন প্রসাব হওয়া, পেটের ভেতরে বাচ্চার নড়চড়া অনুভব করা ইত্যাদি কি হয়না এখানে ! এমনকি নয় মাস শেষে একসময় লেবার পেইনও শুরু হয়।
যদিও আমাদের দেখার সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য হয়নি, তবে ম্যাডামদের কাছে শুনেছি, একসময় যখন আল্ট্রাসনোগ্রাফি ছিল না, তখন লেবার পেইন নিয়ে আসা এই রকম রোগীকে শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান করে প্রমাণ করতে হত যে সে প্রেগন্যান্ট নয়। কারণ, এই সকল কেসে সবচেয়ে বেশী ঝামেলা করে রোগীর আত্মীয়-স্বজন । তাদের বলেও বোঝানো যায়না বিষয়টা। এমনকি আমার রোগীর লোক আল্ট্রাসনো দেখেও বিশ্বাস করেনি । দীর্ঘ সময় কাউন্সেলিংয়ের পর রোগীর স্বামী বুঝলেও রোগীর চোখেমুখে তখনও অবিশ্বাসের ছাপ, 'দেখি, ঠাকুর কি করে !'
একটি প্রেগন্যান্সী : একটি স্বপ্ন, একটি আশা, সাজানো সংসারে একটি নতুন ছোঁয়া। কেউ আসছে তার জন্য অনেক আকাঙ্খা, অনেক প্রস্তুতি। শেষ মুহূর্তে যখন জানতে পারে সবটাই মিথ্যা, সবটাই ভ্রান্তি, তখন মেনে নেয়াটা সহজ ব্যপার নয়। এই সকল রোগীরা মানসিকভাবে যথেষ্ট ভেঙে পড়ে। বিশেষত: আমাদের দেশে সামাজিকভাবেও এদের হেয় করা হয়, হাসাহাসি করে এদের যন্ত্রণা আরও অধিকতর করা হয়। অথচ একটা কথা আমরা ভুলেই যায়, স্বপ্নটা তো তারই ভেঙেছে, আমাদের নয়। সুতরাং, রোগী এবং রোগীর পরিবারকে বৈজ্ঞানিক জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে বুঝিয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং সাইকো সোশ্যাল সাপোর্টই মূলত: এই সকল রোগীর মূল চিকিৎসা।