পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা PCOS :
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা PCOS হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন মহিলাদের সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্ট্রেরন হরমোন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ PCOS থাকা নারীদের ওভারিতে ছোট ছোট অনেক সিস্ট হয়। এজন্য একে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বলে। মূলত: সিস্টগুলো যখন ছোট থাকে তখন তা ক্ষতি নয়, আকার বড় হলেই তা ক্ষতিকর হয়। এগুলোই হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য দায়ী। সাধারণত: PCOS এর কারণে নারীদের ঋতুচক্রে অনিয়ম, প্রজননে সমস্যা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাই প্রাথমিক অবস্থায় লক্ষণগুলো সনাক্ত করে ওজন কমানোসহ চিকিৎসা শুরু করা হলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সিস্ট হলো ছোট পানি ভরা থলি, আর একাধিক সিস্টকে একসঙ্গে বলা হয় পলিসিস্ট। আর ওভারি যে ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ অরগ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম তা নিশ্চয়ই সবার জানা। ছোট ছোট সিস্ট (১০-১২টি) পুঁতির মালার মতো দেখতে ওভারি বা ডিম্বাশয়কে ঘিরে থাকে। এই সিস্টের জন্য ওভারির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
পলিসিস্টিক ওভারিতে সমস্যাঃ
১. শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমা।
২. ঠোঁটের নিচে, গালে বা চিবুকে কখনোবা বুকে, পেটে, পিঠেও পুরুষালি লোম গজায় (যা ওভারি থেকে মাত্রাতিরিক্ত পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন বেড়ে যায় বলে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়)।
৩.পিরিয়ডের গোলমালের সুত্রপাত হয়, শুরুতে দুই-তিন মাস পরপর পিরিয়ড হয়। কখনোবা হরমোনের তারতম্য বেশি হলে বছরে দুই-তিনবার বা তারও কম পিরিয়ড হয়। কারো আবার অতিরিক্ত ব্লিডিং হয়। বিবাহিতাদের সন্তান ধারণে সমস্যা হয় অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য।
৪।অনেক ক্ষেত্রেই ইনফার্টিলিটির এক অন্যতম কারণ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।অনিয়মিত মাসিক এবংবন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ পলিসিস্টিক ওভারি ৷ মেয়েদের হরমোনাল সমস্যার মধ্যে ৫-১০ % এই পলিসিস্টিক ওভারি ৷ এই রোগটি যখন অনেক গুলো উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয় তখন একে বলা হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম ৷ সংক্ষেপে PCOS ৷
PCOS এর কারণ?
PCOS এর সঠিক কারণ যদিও অজানা। কিন্তু ডাক্তারা বিশ্বাস করেন যে, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং বংশগতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ ক্ষেত্রে। যেসব নারীর মা এবং বোনের PCOS আছে তাদের PCOS হবার সম্ভাবনা বেশি। তবে নারীদের শরীরে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেনের অত্যাধিক উৎপাদনও এর আরো একটি কারণ। অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নারী দেহেও উৎপাদিত হয় কিন্তু PCOS থাকা নারীদের দেহে মাঝে মাঝে এর উৎপাদনের মাত্রা বেড়ে যায়। যা ডিম্বাশয় থেকে ডিম বের হওয়া এবং এর বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।অতিরিক্ত ইন্সুলিন উৎপাদনও অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি কারণ হতে পারে। ইন্সুলিন হচ্ছে এমন একটি হরমোন যা শর্করা এবং শ্বেতসারকে শক্তিতে রুপান্তরিত করতে সাহায্য করে।
PCOS এর লক্ষণ বা উপসর্গ?
PCOS এর উপসর্গ শুরু হয় সাধারণত নারীদের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার পর থেকেই। তবে উপসর্গের ধরণ এবং তীব্রতা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তবে সবচেয়ে সাধারণ যে উপসর্গ সবার মাঝে দেখা দেয় তা হলো অনিয়মিত পিরিয়ড।
যেহেতু PCOS এ নারী হরমোনের পরিমান কমে পুরুষ হরমোনের পরিমান বেড়ে যায় তাই নারীদের মাঝে তখন কিছু পুরুষালী বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে থাকে।
- মুখে, বুকে, পেটে, হাতে এবং পায়ের আঙ্গুলে অবাঞ্ছিত চুল গজানো
- স্তনের আকার ছোট হয়ে যায়
- গলার স্বর গভীর হয়ে যায়
- চুল পড়তে শুরু করে
এছাড়া অন্যান্য উপসর্গ:
- ব্রণ, ত্বকে আঁচিল
- শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাওয়া
- কোমরের নিচের অংশ ব্যাথা
- মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
- বন্ধ্যাত্ব
- ওভারি আকারে বড় হয়ে যায় এবং ডিম্বাশয়ের চারদিকে অসংখ্য তরল পূর্ণ সিস্ট তৈরি হয়
- অনিদ্রার এবং ঘুমের সময় নিঃশ্বাসে সমস্যা
- অতিরিক্ত ইন্সুলিনের উৎপাদন
- কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া
- ডায়াবেটিস হওয়া
উল্লিখিত উপসর্গের অনেকগুলোই অনেকের ক্ষেত্রে হয়ত দেখা নাও দেখা দিতে পারে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা PCOS এর চিকিৎসা পদ্ধতি ?
ডা: নুসরাত জাহান (সহকারী অধ্যাপক(গাইনী-অবস) ডেলটা মেডিকেল কলেজ) মনে করেন, পিসিওএস এর নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নাই। লক্ষণ এবং রোগীর চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়।যারা বাচ্চা নিতে আগ্রহী তাদেরকে ডিম্বস্ফুটনের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষুধ দেয়া হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে অপারেশন করার দরকার হতে পারে। সাধারণত ল্যাপারোস্কপি করে সিস্ট রাপচার করা হয়(ওভারিয়ান ড্রিলিং)। এই চিকিৎসা পদ্ধতি ওভারি থেকে হরমোনের অস্বাভাবিক নি:সরণকে স্বাভাবিক করে ডিম্বস্ফুটনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যারা বাচ্চা নিতে চান না এবং অনিয়মিত মাসিকে ভুগছেন তাদেরকে মাসিক নিয়মিত করার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল বা প্রজেস্টেরন জাতীয় ঔষুধ দেয়া হয়। এই ঔষুধগুলো একদিকে যেমন হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে মাসিক নিয়মিত করে, অন্যদিকে পুরুষ হরমোনের মাত্রা ঠিক করে ত্বকের ব্রন ও অতিরিক্ত লোম দূরীকরণে সাহায্য করে। পিসিওএস এ যারা ভুগছেন তাদের কিছু দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা হবার সম্ভাবনা থাকে। পিসিওএস আক্রান্তদের শরীর ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এরফলে রক্তে শর্করার পরিমান বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া কোলেস্টেরলের মাত্রা,হৃদরোগ ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুকি বেড়ে যায়। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস এর মাধ্যমে জটিলতা এড়ানো যায়। পিসিওএস এর মূল নিরাময়ক হচ্ছে নিয়মিত শরীরচর্চা এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহনের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা। সঠিক ওজন শরীরে হরমোনের ভারসম্য ফিরিয়ে আনে এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা হবার ঝুকি কমিয়ে দেয়।
অধ্যাপক হোসনে আরা বেবী (ইনফারটিলিটি বিশেষজ্ঞ। ইনফারটিলিটি কেয়ার এন্ড রিসার্চ সেন্টার) মনে জানান-
বাচ্চা না হবার জন্য যেসব মেয়েরা আমাদের কাছে আসে, তাদের একটা বড় অংশ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রম রোগে ভুগে থাকে। এসব রুগী যখন খুব চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করে-'আমার অনেক সমস্যা- মাসিক অনিয়মিত,হরমনের সমস্যা গায়ে লোম বেশি, ওভারিতে সিস্ট, আমার কি বাচ্চা হবে'? অজান্তে বলে ফেলি- 'তোমার তেমন কোন সমস্যা নেই, তোমার বাচ্চা হবে।' কারন এসব রুগীদের বাচ্চা হবার জন্য চিকিৎসা লাগে ঠিকই কিন্তু বাচ্চা হবার সম্ভাবনা এদের খুব বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড়া, বেশিরভাগ রুগী সামান্য চিকিৎসায়ই গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়। এইসব রুগীদের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রচুর ডিম্বাণু থাকা সত্ত্বেও তাদের বাচ্চা হয় না ডিম্বানু পরিপক্ক ও ওভুলেশন না হওয়ার কারনে। সুতরাং এদের চিকিৎসা হচ্ছে ওভুলেশন করানো। ওভুলেশন করানোর জন্য বহুধরনের ড্রাগ আমাদের দেশে পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হল - এসব রুগীদের ওভুলেশন করানো একটা আর্ট- পর্যাপ্ত জ্ঞান ও ব্যবহারিক শিক্ষা না থাকলে তা সম্ভব হয় না। এদের চিকিৎসা করতে হয় ধাপে ধাপে। প্রতিটি ধাপে দরকার হয় মনিটরিং। আর সে মনিটরিং এর জন্য আবশ্যক একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম। যা থাকতে হবে গাইনোকলোজিস্টের হাতের কাছেই।কারো কারো শুধুমাত্র একটা ড্রাগেই কাজ হয়, কারো দুইটা,কারো তিনটা, কারো লাগে ইঞ্জেকশন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ল্যাপারস্কোপির দরকার হয়। খুব কম ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় উন্নত চিকিৎসার যেমন- আই ইউ আই ও আই ভি এফ বা টেস্টটিউব বেবী। এছাড়া ওভুলেশন করার পাশাপাশি এদের আরো কিছু চিকিৎসার দরকার হয়। যেমনঃ ওজন কমানো (ডায়েট ও এক্সারসাইজ), হরমনের সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা, হাই প্রেসার থাকলে ,ডায়েবেটিস থাকলে তার চিকিৎসা এবং সর্বোপরি সবসময় ফলো আপ এ থাকা। কারন পরবর্তীতে এদের হাই প্রেসার, ডায়েবেটিস,হার্টের রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
ডা. হাসরাত জাহান, (সহযোগী অধ্যাপক, শিশুমাতৃ স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট,মাতুয়াইল, ঢাকা) ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তে একটি জাতীয় পত্রিকায় চিকিৎসা নিয়ে একটি উপদেশ দেন , তার মতে , সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস এবং পরিমিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে আনুন পরিমিত ওজন আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাবে এবং মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করবে। -যারা এখনই গর্ভবতী হওয়া নিয়ে ভাবছেন না, বিশেষ করে যারা অবিবাহিত তাদের ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বেশ কার্যকর। পিল সেবনে মাসিক নিয়মিত হয়। রক্তে পুরুষ হরমোনের মাত্রা কমে, অতিরিক্ত লোম এবং ব্রণের সমস্যাও কমে।
ডা. কানিজ ফাতেমা ডোনা ২০১৪ সালের ১৮ জানুয়ারিতে যুগান্তর পত্রিকায় এর চিকিৎসা নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখেন যা নিম্নে দেয়া হলো-
PCOS এর চিকিৎসা : প্রথম চিকিৎসা মেদ কমানো। একই সঙ্গে লো ডোজের মুখে খাওয়ার জন্মবিরতিকরণ বড়ি দেয়া হয়। এই পিলস এন্ড্রোজেনের মাত্রা কমায় এবং ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন মাত্রাকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। যাদের সন্তান ধারণে অসুবিধা হচ্ছে তাদের মেটফরমিন নামে এক ধরনের ওষুধ দেয়া হয়, যা ডিম্বাণুু নিষিক্তকরণে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিসের ওষুধ হওয়া সত্ত্বেও ডিম্বাণু নিঃসরণে সাহায্য করে। ওষুধ তিন থেকে ছয় মাস খেতে হয়। অবাঞ্ছিত লোমের জন্য ইলেকট্রোলিসিসের সাহায্য নিতে হতে পারে। অনেক সময় মেয়েরা সাইক্লোলজিক্যালি ডিপ্রেশনে ভোগেন, এক্ষেত্রে কাউসেলিংয়ের প্রয়োজন হয়।
ঈহিতা জলিল , ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) একটা তথ্যবহুল রিপোর্ট প্রকাশ করে PCOS এর উপর তা নিম্নে দেয়া হলো-
কোমরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন ১৮ বছরের তরুণী কুসুম। ৭-৮ মাস আগে একদিন হঠাৎ-ই তার এই ব্যথা শুরু হয়। সবাই ধরেই নিয়েছিল এটি কোমরের হাড়ের কোন সমস্যা। কোন ওষুধেই যখন কোন কাজ হলো না তখন আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়লো তাঁর ডান ওভারিতে একটি সিস্ট রয়েছে, যার আকার ৯ সেন্টিমিটার। ডাক্তারের পরামর্শে অপারেশনের মাধ্যমে সেটি অপসারণ করতে ডান ওভারিটিও কেটে বাদ দিতে হয়।
প্রায়শ:ই পিরিয়ড অনিয়মিত হতো ১৬ বছরের তরুণী পিয়ার। পিরিয়ডের সময় অসহ্য ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে দিন কাটতো তার। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানা গেলো তাঁর ওভারিতে একটি সিস্ট রয়েছে, যার আকার ৫ সেন্টিমিটার। এক্ষেত্রে অপারেশন ছাড়াই ল্যাপরোস্কপির মাধ্যমে সেটি অপসারণ সম্ভব।
নারী দেহের ডিম্বাশয়ে সিস্ট অথবা টিউমার সাধারণ একটি রোগ, কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে পরে শুধু বন্ধ্যাত্ব নয়, দেখা দিতে পারে অন্যান্য নানা শারীরিক জটিলতা। তাই ওভারিয়ান সিস্ট নিয়ে আতংকিত হবার কিছু না থাকলেও এ ধরনের শারীরিক জটিলতায় একজন ডাক্তারের তত্বাবধানে থাকা উচিৎ।
এ ব্যাপারে জেনারেল মেডিকেল হাসপাতাল (প্রা:) লিমিটেডের স্ত্রী-রোগ ও ধাত্রী বিদ্যা বিশেষজ্ঞ (কনসালটেন্ট গাইনী এন্ড অবস্) ডাঃ লায়লা আনজুমান বানু (মেঘলা) জানালেন, ডিম্বাশয় বা ওভারি হচ্ছে জরায়ুর দুপাশে অবস্থিত দুটি ছোট গ্রন্থি, যা থেকে মহিলাদের হরমন নিঃসরণ হয় এবং ডিম্বানু পরিস্ফুটন হয়। এভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ অর্গানটি মেয়েদের পিরিয়ড ও বাচ্চা হতে সহায়তা করে।
তার মতে, ওভারিয়ান সিস্ট হল ওভারিতে পানি পূর্ণ থলে অথবা টিউমার জাতীয় একটি রোগ। মেয়েদের, ঋতুকালীন সময় ও ঋতুবন্ধের পর (মেনোপোজ) এই দুই সময়েই, এই রোগ হতে পারে। ওভারিয়ান সিস্ট অনেক রকম হতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ সিস্টটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে সিম্পল বা ফাংশনাল সিস্ট নামে পরিচিত। ওভারি থেকে কোন কারণে ডিম্বস্ফুটন না হলে অথবা ডিম্বস্ফুটন হবার পরও কোন কারণে ফলিকলগুলো চুপসে না গেলে এই সিস্ট তৈরী হতে পারে। এই সিস্টের আকার সাধারণত ৫ সেন্টিমিটারের নিচে হয় এবং পিরিয়ড হয়ে গেলে এই সিস্ট আর দেখা যায় না। শুধু আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলেই এই সিস্ট ধরা পরে। এতে অন্য কোন সমস্যা যেমন: ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি থাকে না।
ডা: মেঘলা বলেন, এছাড়া পলিসিস্টিক ওভারি হচ্ছে, ওভারির এমন একটা অবস্থা যা হলে রোগীর পিরিয়ড অনিয়মিত হয়, ওজন বৃদ্ধি পায়, কারো মুখে অবাঞ্চিত লোম দেখা দেয়, রক্ত পরীক্ষাতে কিছু হরমন (এফএসএইচ,এলএইচ) লেবেলে তারতম্য দেখা যায়। এতে কোন অপারেশনের প্রয়োজন হয় না ওষুধের মাধ্যমেই ভালো হয়ে যায়।
এন্ডমেত্রিওটিক সিস্ট হলে পিরিয়ডের সময় প্রচুর ব্যাথা হবে, চিকিৎসা না করালে এর আকার ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং সময়মতো চিকিৎসা না নিলে বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগতে হতে পারে। তবে সৌভাগ্যজনক ভাবে যদি এতে আক্রান্ত রোগী গর্ভবতী হয় তবে এটি প্রাকৃতিক ভাবেই ভালো হয়ে যায়। এই সিস্ট আকারে বড় হলে, অপারেশন জরুরী এবং অপারেশন পরবর্তী ৩-৬ মাস নিয়মিত ওষুধ খেলে এটি সম্পূর্ণ ভালো হয়। তবে এই চিকিৎসা গ্রহণের পর রোগীকে দ্রুত বাচ্চা নিতে হবে নতুবা এই সিস্ট আবারো ফিরে আসতে পারে।
ডারময়েড সিস্ট, এটি এমন এক ধরনের ওভারিয়ান টিউমার, যাতে শরীরের অন্যান্য অর্গানের মত টিস্যু থাকে, যেমন: দাঁত, চুল ইত্যাদি। এটি মারাত্মক কিছু না কিন্তু দ্রুত অপারেশনের মাধ্যমে এটি অপসারণ করতে হবে।
ক্যানসার জাতীয় সিস্ট অথবা টিউমার, এই জাতীয় সিস্ট ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের অথবা মেনোপোজের পরে হয়। এতে তলপেটে ব্যথা হয় এবং সিস্টের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ক্যান্সারের অন্যান্য লক্ষণের মতো অরুচি, ওজন কমে যাওয়া ও বমি হতে পারে।
ডা. মেঘলা আরো বলেন, ওভারিয়ান টিউমার মাঝারি আকারের যেমন ৪-১০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকলে সেটি পেঁচিয়ে যেতে পারে। এতে রোগীর তলপেটে ও কোমরে প্রচন্ড ব্যথা হবে সাথে জ্বরও থাকতে পারে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে অপারেশন করাতে হবে।
ওভারিয়ান সিস্টের কারণ সর্ম্পকে বলতে গিয়ে ডা. মেঘলা বলেন, ওভারিয়ান সিস্ট অথবা টিউমার হওয়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় বংশগত, হরমনজনিত, বন্ধ্যাত্ব রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ সেবন, ওজনাধিক্য, স্তন ও খাদ্যনালির ক্যান্সার প্রভৃতি কারণে ওভারিতে সিস্ট হতে পারে।
ওভারিয়ান সিস্টের উপসর্গ একেক জনের একেক রকম হতে পারে। সাধারণত যে উপসর্গগুলো দেখা যায়, সেগুলো হলো একেবারেই পিরিয়ড না হওয়া, ২-৩ মাস অন্তর অধিক রক্তপাত এবং কারো কারো ক্ষেত্রে সামান্য অথবা প্রচুর রক্তপাত (যদি সেটি হরমন প্রডিউসিং টিউমার হয়)।
ডা. মেঘলা ওভারিয়ান সিস্ট নির্ণয় সর্ম্পকে বলেন, এই রোগ নির্ণয় করতে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়। এছাড়া সিটিস্ক্যান, এমআরআই, হরমন লেভেল দেখা, সিএ-১২৫ ও ল্যাপরোস্কপি ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগ নির্ণয় করা হয়।
যেক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে না সেগুলোতে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। আর ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকলে, প্রচন্ড ব্যথা থাকলে ও সিস্ট বড় হতে থাকলে অপারেশন করা হয়। এছাড়া ল্যাপরোস্কপি, ল্যাপারোটমি করা হয়। আর ক্যান্সার হলে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ফাংশনাল সিস্ট নিশ্চিত হওয়া না গেলে, ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকলে, সিস্টের আকার ৫ সেন্টিমিটারের বেশি হলে, প্রচন্ড ব্যথা থাকলে এবং সিস্ট বড় হতে থাকলে অপারেশন করা হয়।
ডা. মেঘলা আরো বলেন, ওভারিতে সিস্ট থাকলে সন্তান হবে না এটি ভাবার কোন কারণ নেই। যে ওভারিতে সিস্ট হয়েছে সেটি যদি ক্যান্সার জাতীয় না হয় তবে সিস্ট ফেলে ওভারিটি রাখা যায়। উল্লেখ্য, একটি ওভারির ৭ ভাগের ১ ভাগ রাখা গেলেই সেটি একটি স্বাভাবিক ওভারির মতোই কাজ করে। যদি একটা ওভারি ফেলেও দেয়া হয় সেক্ষেত্রে একটা ওভারি দিয়েও সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম(PCOS) আজকাল অনেকটা সাধারণ একটি রোগে পরিণত হয়েছে। অনেক নারীর মাঝেই এটি দেখা যাচ্ছে। এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নারীদের ঔষধ খেতে হয়, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হয় এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে ব্যায়ামও করতে হয়। তবে অনেকেই জানেন না এই রোগ প্রতিরোধের কিছু ঘরোয়া উপায়ও রয়েছে। উপকরণগুলো আমাদের রান্না ঘরেই পাওয়া সম্ভব এবং সেগুলো প্রতিদিনের খাবারে যোগ করুন।
চলুন তাহলে জেনে নেই উপাদান গুলো সম্পর্কে-
মেথিবীজ
যে নারীদের PCOS থাকে তাদের অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন হরমোন দেহের কোষে কার্যকর ভাবে ব্যবহৃত হতে পারেন না। এর ফলে ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং টেস্টোস্টেরন হরমোনের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই মেথিশাক বা বীজ খাওয়ার ফলে তা ইন্সুলিন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে মেথি দেহের গ্লুকোজের সহনশীলতার মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। ৩ চা চামচ মেথি বীজ ভালো করে ধুয়ে সারারাত দেড় কাপ পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন ৩ বারে সেটি খান, সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এবং দুপুরে ও রাতে খাওয়ার ৫ মিনিট আগে। এছাড়া খেতে পারেন মেথি শাকও।
দারুচিনি
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের মতে এই মশলাটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর রয়েছে রক্তের শর্করার মাত্রা স্থির রাখার ক্ষমতা এবং ইনসুলিন প্রতিরোধক কমাতে সাহায্য করে। তাই মিল্কশেক বা দইয়ে মিশিয়ে দারুচিনি খেতে পারেন, কেক বা মাফিন তৈরিতে ব্যবহার করতে পারেন বা চায়ের সাথে সামান্য কিছু দারুচিনি গুঁড়ো মিশিয়েও খেতে পারেন। আর এতে ক্যালরির পরিমান খুবই কম তাই ওজন বৃদ্ধির কোনো চিন্তা থাকবেনা।
তিসিবীজ
ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬ এর সমৃদ্ধ এই বীজটি খাদ্যআঁশের খুবই ভালো একটি উৎস এবং এতে আরো থাকে লিগনান নামক এক ধরনের প্রোটিন যা টেস্টোস্টোরেন হরমোনের উৎপাদন কমাতে সাহায্য করে। পুষ্টিবিদদের মতে তিসিবীজ দেহের গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের যথাযথ ব্যবহার হতে সাহায্য করে এবং PCOS এর বেশিরভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। তিসিবীজকে গুঁড়ো করেই সকালের নাস্তায় বা জুসের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। চাইলে খাবার পানির সাথেও সামান্য কিছুটা মিশিয়েও খেতে পারেন।
তুলসি পাতা
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের মতে PCOS থাকা নারীদের ডিম্বস্ফোটন না হওয়ার কারণে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না। এছাড়া লিভার থেকে উৎপন্ন হওয়া প্রোটিন ‘সেক্স হরমোন বাইন্ডিং গ্লোবিউলিন’(SHBG) এর উৎপাদনও খুব কম হয়। এর ফলেই PCOS থাকা নারীদের মুখে অবাঞ্ছিত চুল গজায়, ব্রণ হয় এবং বাচ্চা নিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তুলসি পাতা অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ইন্সুলিনের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। এটি একটি চমৎকার অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও। সকালে খালি পেটে ১০টি তুলসি পাতা চিবিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া তুলসি পাতা দিয়ে সেদ্ধ করা পানি খেতে পারেন নিয়মিত।
মধু
স্থূলতা এবং PCOS একটি অন্যটির সাথে জড়িত। PCOS এর সমস্যা থাকলে তা হরমোনের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যা দেহকে স্থুলতার দিকে নিয়ে যায়। যদি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে তা থেকে বিভিন্ন রোগের সূত্রপাত হতে পারে যেমন আর্থাইটিস বা হৃদরোগ ইত্যাদি। পুষ্টিবিদদের মতে মধু ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে এবং পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয়। এক গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন খুব সকালে খালি পেটে খেতে হবে। এটি দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করবে। তবে মনে রাখতে হবে মধু মিশিয়ে কখনোই গরম করা যাবে না বা সেই মিশ্রণটি রেখে দিয়ে পরে খাওয়া যাবে না এর ফলে মধুর কার্যকারিতা নষ্ট হয় এবং তখন এটি দেহের ওজন বাড়াবে।
করলা ও পটল
ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণত করলা এবং পটল খেতে বলা হয়ে থাকা ইনসুলিন এবং গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য। এগুলোর পাতা এবং সবজি দুটিই খেতে পারে PCOS থাকা নারীরা। তারা এগুলো রান্না করে সপ্তাহে ৫দিন খেতে পারে। এছাড়া ভালো উপকার পেতে যদি সম্ভব হয় করলা ব্লেন্ড করে জুস বানিয়ে খেতে পারে।
আমলকী
ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ আমলকীতে রয়েছে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণের এবং নারীদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর দারুন ক্ষমতা। পুষ্টিবিদদের মতে এটি দেহের দূষণ দূর করার চমৎকার একটি উপাদানও বটে। এটি দেহের দূষিত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে যার ফলে দেহের ওজনও কমে। আমলকী রস করে কুসুম গরম পানির সাথে মিশিয়ে নিয়মিত খেতে পারেন। এছাড়া কাঁচাও খেতে পারেন বা দইয়ের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।