রাজডক - Rajdoc
Banolata-2023-03-09.gif
Banolata-2024-03-09.gif

ডাঃ এর সিরিয়াল দিন

শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর (লক্ষন, প্রতিকার ও প্রতিরোধ) - ডা: তানিয়া আক্তার জাহান

১৯-০৮-২০২৩

শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর (লক্ষন, প্রতিকার ও প্রতিরোধ) - ডা: তানিয়া আক্তার জাহান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (CDC) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ রয়েছে ছয়টি-
১।ডেঙ্গু
২।জিকা
৩।চিকুনগুনিয়া
৪।ম্যালেরিয়া
৫।ফাইলেরিয়া(গোদরোগ)
৬।কালাজ্বর

বাংলাদেশে বর্তমানে নতুন করে জাপানিজ এনকেফালাইটিস দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পশ্চিম নীল ও জিকা রোগ দেশে প্রবেশ করেছে। তবে পীতজ্বর দেশে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব রোগের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছডাচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। আজ আমরা জানবো শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর সংক্রান্ত বিষয়াবলী।


ডেঙ্গু জ্বর কী:
এটি একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। ভাইরাসটির ৪টি সেরোটাইপ। একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারের সংক্রমণ রোগীর জটিলতা অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হয়।


সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। এটি চীনে ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে শনাক্ত করা হয়েছিল। প্রথম ডেঙ্গু মহামারী হয় ১৯৫০ সালে। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ১৯৬০ সালে। বর্তমানে ১০০ টিরও বেশী দেশে ভেঙ্গু জ্বর দেখা যায়। এর অনেকগুলো নাম রয়েছে - "বিষাক্ত পানির রোগ', 'হাড়ভাঙ্গা রোগ', 'ঢাকা ফিভার’।


বংশ ও বিস্তারঃ
সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ ও পর্শ্ববর্তী এলাকায় এডিস নামক স্ত্রী জাতীয় মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগ হয়। আগে প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর রোগটি হতো, তবে এখন প্রায় সারা বছরই থাকে। জলাবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যার আধিক্য, জলাবদ্ধতা, পরিচ্ছনতা ও সচেতনতার অভাব- এসব বিভিন্ন কারণে একদিকে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ যেমন বেড়েছে অন্য দিকে এডিস মশার জীবন চক্রেও এসেছে পরিবর্তন। আগে শুধু সকাল/সন্ধ্যায় কামড় দিতো কিন্তু এখন দিনের যে কোন সময় এডিস মশা দেখা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভিতরেও ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এসব আক্রান্ত মশা যাদের কামড়াবে তাদের শরীরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছরের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর অস্বাভাবিক বিস্তার শুরু হয়েছে। এবারের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ও তুলনামূলক বেশি।

শিশু সংক্রমন ও জটিলতার কারনঃ
ডেঙ্গু রোগে শিশু আক্রান্তের হার বেশি, জটিলতাও বেশি। এর কিছু কারন রয়েছেঃ
-শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
-রোগের লক্ষন দেরিতে প্রকাশ পায়।
-দেরীতে হাসপাতালে নেয়া।
-খেতে না চাওয়া।
-নিজের সমস্যা বুঝতে ও বলতে না পারা।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, নারীরা গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রসবের সময় ভূমিষ্ট নবজাতকেরও তা হবার সম্ভাবনা আছে।

ডেঙ্গুজরের প্রকারভেদ ও লক্ষনঃ
ডেঙ্গু জরের লক্ষনগুলো সাধারণত সংক্রমনের ৩-১৪ দিনের পরে শুরু হয়। অন্যান্য সংক্রমনের সাথে ডেঙ্গু জরের পার্থক্য হলো জ্বর নেমে যাবার পর থেকে ক্রিটিক্যাল ফেজ শুরু হয়। তাই জ্বর শুরু হবার ৩য় থেকে ৮ম দিন অথবা জ্বর নেমে যাবার পর পরবর্তী ৩ দিন পর্যন্ত বাবা-মাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়।

সাধারন/ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জরের উপসর্গঃ
-উচ্চ মাত্রায় জ্বর (প্রায় ১০৪° F) তবে এর কম ও হতে পারে।
-বমি বমি ভাব/বমি
-খাওয়ার অরুচি
-মাথা ব্যাথা
-শরীরের বিভিন্ন জায়গার সংযোগ ও মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা
-সর্দি-কাশি ও পাতলা পায়খানা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে

তীব্র ডেঙ্গু জরের লক্ষনঃ
-উপসর্গের ১ম/২য় দিনে ত্বকে লাল ফসকুড়ি অথবা 8 থেকে ৭ দিনের মধ্যে হামের মতো লাল বিন্দু দেখা যেতে পারে।
-তীব্র পেটব্যথা, বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
-নেতিয়ে পড়া
-রক্ত বমি হওয়া
-রক্তের অনুচক্রিকার মাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া।
-দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
-কালো পায়খানা
-শ্বাসকষ্ট
-অস্থিরতা
এগুলো বিপজ্জনক চিহ্ন হিসেবে স্বীকৃত।

মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃ
ডেঙ্গু জরের ৫ থেকে ৭ দিনে সময়কালে মারাত্মক ডেঙ্গুর চিহ্ন দেখা যেতে পারে-
-ডেঙ্গু শক সিনড্রোম
-অভ্যন্তরীণ রক্তপাত
-রক্তচাপ বিপজনক মাত্রায় নেমে যাওয়া
-শরীরে পানি জমা
-শীতল শরীর (৯৮.৮°F এর কম)
-নাড়ি দুর্বল
-শিশু অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
-খিচুনি হতে পারে
-এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

শিশুর ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়ঃ
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুর জ্বর হলে ‘মৌসুমী জ্বর’ মনে করে ঘরে বসে থাকা যাবে না। জ্বর হবার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যুহার ১ শতাংশ বা তারও কম।

ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণ উপসর্গ দেখা দিলে করণীয়ঃ
-ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করুন।
-চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
-শিশুর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করুন।
-শিশুকে মশারীর ভিতর রাখুন অন্যরা যাতে সংক্রমিত না হয়।
-জ্বর থাকলে কুসুম গরম পানি দিয়ে বারবার মুছে দিন এবং শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাওখান।
-ছোট শিশু হলে ঘনঘন বুকের দুধ খাওয়ান।
-শিশুকে পানি, খাওয়ানোর পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার বিশেষ করে স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত, গ্লকোজ, স্যুপ, চিড়া পানি, ভাতের মাড় ইত্যাদি খাওয়ান।

শিশুর উপসর্গগুলোর দিকে খেয়ান রাখুনঃ
-বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন/শিশুকে হাপাতালে নিন।
-দৈনিক অন্তত ৬ বার পেশাব হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখুন।

শিশুর ডেঙ্গু জ্বরে কি করা যাবেনাঃ
-আতঙ্কিত হবেন না
-জ্বর কমানোর জন্য ডাইক্লোফেনাক সাপোজিটরি দিবেন না
-মাংসপেশিতে কোন ইঞ্জেকশান পুশ করবেন না
-অহেতুক আান্টিবায়োটিক খাওয়াবেন না

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়ঃ
-শিশুকে ফুলহাতা শার্ট ফুলপ্যান্ট, মোজা পরান।
-দিনে/রাতে ঘুমানোর সময় মশারী টাঙ্গান।
-প্রয়োজনে শিশুর শরীরে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করুন।
-বাড়ির ভিতরে ও চারপাশ পরিষ্কার রাখুন।
-শিশুর পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করুন
-টিকা/ভ্যাক্সিন বহির্বিশ্বে এসেছে, আমাদের দেশে এখনও সহজ লভ্য নয়।

ডেঙ্গু পরবর্তী জটিলতাঃ
-চুল পড়ে যাওয়া
-জয়েন্ট/মাংস পেশীর ব্যথা
-পুষ্টি হীনতা (বিশেষ করে ভিটামিন ডি ও বি)
-স্নায়ুরোগ (ট্রান্সভারস মাইলাইটিস গিল্মে বারি সিনড্রোম)
-ডিপ্রেশন


বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বর সাধারণ ধরনের এবং জটিলতাবিহীন। এসব শিশু যদি মুখে খাবার ও পানীয় পান করতে পারে, এবং প্রতি ৬ ঘন্টায় একবার পেসাব করে এবং শরীরে কোন বিপজ্জনক লক্ষন না থাকে, তবে বাসায় রেখে প্রাথমিক চিকিৎসায় শিশু সুস্থ হবার সম্ভাবনাই বেশী।

পরিশেষে বলি -
"আসুন, আতঙ্কিত নয়, সচেতন হই। শিশুকে যত্নে রাখি, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখি।“

প্রবন্ধটি লিখেছেন-
ডাঃ তানিয়া আক্তার জাহান
এমবিবিএস, ডিসিএইচ
শিশু ও নবজাতক রোগ বিশেষজ্ঞ
শিশু হৃদরোগ বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত (NICVD)

এই পাতাটি ৬৪৬বার পড়া হয়েছে

স্বাস্থ্য প্রবন্ধ



যোগাযোগ
প্যারামেডিকেল রোড
লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী
Email: info@rajdoc.com
Phone: +8801753226626