রাজশাহীসহ সারা বাংলাদেশে বাড়ছে জন্ডিস রোগ।। ডাঃ শেখ মোঃ আফজাল উদ্দীন এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন)
বর্তমান সময়ে, রাজশাহীসহ সারা বাংলাদেশে জন্ডিস রোগ প্রচন্ড পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। এটি মূলত পানি বাহিত হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস দ্বারা হলেও এটি রক্তবাহিতও হতে পারে। যেমন হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস। তবে মুলত এটা পানি বাহিত রোগ। এটির ব্যাপকতা আসলে বাহিরের পানি পান বা ব্যবহার থেকে হতে পারে। বাসা-বাড়ির বাহিরে ফুটানো পানি, জীবানুমুক্ত পানির পরিবর্তে ব্যবহৃত সাপ্লাই লাইনের পানি বা ময়লা পানি যা আমরা জানি না, অফুটানো পানি ব্যবহারে বা এরূপ পানি যার সাথে জীবানু বা অন্য কোনো কন্টামিনেশন মিশ্রিত হওয়ায় হতে পারে। বর্তমান সময়ে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে হয়তো এ বছরে এর সংক্রমন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। বাহিরে বিভিন্ন জায়গায় বা খাবার হোটেলে আমরা খাবার খেলে যখন বাহিরের পানি পান করি, তখন এর সংক্রমনের সম্ভাবনা থাকে। এতে করে এই ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে এবং আমাদের লিভার হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা সাধারণত বলে থাকি বা দেখতে পাই যে জন্ডিস হলে চোখের সাদা অংশ হলুদ হলুদ একটা রঙ হয়ে আসে, শরীরে ও হাত-পায়ের রঙে একটু হলুদ আভা দেখা যায়, খাবারে অরূচি হয়, বমি বমি ভাব হয়, এমনকি বমি হতেও পারে এবং পেট ব্যাথা হয়। এটি হওয়ার কারণ মূলত লিভার আক্রান্ত হওয়ার জন্য। এর জন্য লিভার কে বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা অনেকেই এতে একটা ভূল ধারণা করি যে লিভারের ক্ষতি হয়েছে ভেবে, নানা ক্ষেত্রে ভূল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভূল স্থানে ভুল চিকিৎসা নেই। যেমনঃ কবিরাজের কাছে বা লিভারের ডাক্তারের কাছে গিয়ে লিভারের জন্য ক্ষতিকারক কিছু ঔষধ সেবন করি। এতে করে লিভারের বিশ্রামের স্থলে অতিরিক্ত খাটুনি করানো হয়ে যায়, যাতে লিভারের আরও ক্ষতি হয়। কিন্তু এই কাজ করে আমরা অনেকে মনে করি যে অতিরিক্ত খাটিয়ে নিলে হয়তো সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এতে করে লিভার বা যকৃত আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই অবস্থায় লিভারকে অতিরিক্ত খাটানো হলে, লিভার সামঞ্জস্য করা জন্য ব্রেইন বা কিডনির ক্ষতি করে রোগীর মৃত্যু ঘটাতে পারে।
জন্ডিস খুবই সাধারণ একটা রোগ; সাধারণত পর্যাপ্ত বিশ্রাম করলে ২ থেকে ৪ সপ্তাহে এমনিতেই সেরে উঠে। এসকল অহেতুক কবিরাজের দেওয়া মালা পরার বা লিভার টনিক খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আবার কিছু কুসংস্কার আছে, যেমনঃ হলুদ খাওয়া যাবে না, অনেকে ওঝা জাতীয় লোকেদের কাছে হলুদ ঝাড়া নেওয়ারমত কাজগুলো করে থাকে। মূলত, শরীরে বিলিরুবিন টা বেড়ে যাওয়ার কারণে হলুদ আভাটা দেখা যায়, আর তাদের মতে বিলিরুবিন হলুদের মাধ্যমে পানি হয়ে ঝরে পরে। এটি কুসংস্কার ও মিথ্যে বানোয়াট কথা ব্যাতিত কিছুই না।
আমাদেরকে এইসকল বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে, কারণ জন্ডিসের চিকিৎসা হলো মূলত বিশ্রাম। বিশ্রাম বিশ্রাম আর বিশ্রাম। আর ২য় কোনো চিকিৎসা যদি জানতে চান তাহলে সেটি হলো সাধারণ ভালো খাবার। তবে তেল-চর্বি যুক্ত খাবার ১ থেকে ২ সপ্তাহ পরিহার করা উত্তম। খাবার যদি পেটের জন্যে সহজে পচনশীল হয়, তবে সবচেয়ে ভালো হয়। আর শরীরে যেহেতু জ্বর আসে এই সময়ে, এতে খাবারে অরূচী থাকতে পারে। তার জন্য ফ্লুইড বা তরল জাতীয় খাবার ২ লিটার থেকে ৩ লিটারের মাঝে রাখলে ভালো হয়।
কিছু কিছু লক্ষন জাতীয় চিকিৎসা আছে, যেমনঃ অরূচীর জন্য অরূচী দূর করার চিকিৎসা আছে, অনেকের পেটে জ্বালাপোরা করে, তার জন্য চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে, আবার বমি বন্ধের জন্য কিছু ঔষধ আছে যা ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্ষেত্র বিশেষে, রোগীর জন্য নিরাপদ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা বাধ্যতামূলক নয়, রোগীর উপর নির্ভর করে এই চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, জন্ডিসের ক্ষেত্রে লিভারের জন্য প্যারাসিটেমল জাতীয় ঔষধ না খাওয়া ভালো। জন্ডিস ভালো হওয়ার পর খেতে পারবে, তবে জন্ডিস হওয়া অবস্থায় না খাওয়াই উত্তম। এই সময়ে এনএসএইড গ্রুপ যেমনঃ ক্লোফেনাক, ন্যাপপ্রোক্সিন বা সাপোজিটরি ব্যবহার করা যেতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য মূলত আমরা এগুলোর ব্যবহার করতে পারি।
আবার বর্তমান সময়ে প্রচুর ডেঙ্গুও হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে এনএসএইড গ্রুপ পরিহার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ব্যবহার করেই জ্বর কমানোর চেষ্টা করতে হবে। কারণ এনএসএইড গ্রুপের ঔষধ গুলো রক্তের প্লাটিলেট কমিয়ে ফেলে, আর ডেঙ্গুও রক্তের প্লাটিলেট কমিয়ে ফেলে। এই কারণে ডেঙ্গু হলে প্যারাসিটেমলের ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো একজন পরিক্ষক দ্বারা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে জ্বরটা আসলে কিসের জন্য হচ্ছে, ডেঙ্গু নাকি জন্ডিস। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্যারাসিটেমল ব্যবহার করতে হবে এবং জন্ডীসের ক্ষেত্রে এনএসএইড গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
বর্তমান সময়ে জন্ডিস ও ডেঙ্গু দুটোরই প্রকোপ আছে। ডেঙ্গু জ্বরও সুচিকিৎসায় ভালো হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বরেও ভয়ের কিছু নেই। আমরা যদি সুচিকিৎসা গ্রহণ করি বা একজন সুচিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করি তবেই সুস্থ থাকতে পারবো আমরা। কিন্তু বিভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করলে আমরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবো।
আমরা সকলে সচেতন তার সাথে চলাফেরা করলে এই জন্ডিস বা ডেঙ্গু থেকে সহজেই সুস্থতা অর্জন করতে পারবো। আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আশা করছি আপনারা সকলে ভালো থাকবেন।
ডাঃ শেখ মোঃ আফজাল উদ্দীন
এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন)
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক(মেডিসিন)
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাজশাহী