রাজডক - Rajdoc
Banolata-2023-03-09.gif
Banolata-2024-03-09.gif

ডাঃ এর সিরিয়াল দিন

শিশুর খাদ্যে তীব্র অনীহাঃ আসলেই কি এটা রোগ?

২৬-০২-২০২১

শিশুর খাদ্যে তীব্র অনীহাঃ আসলেই কি এটা রোগ?

কেস ১ঃ নাফিসার বাচ্চাটা ৭ মাসে জন্মেছে, ওজনও কম ছিল। ১৬ দিন আইসিইউতে রাখার পর বাচ্চা যখন মায়ের কাছে দেয়া হলো তখন বাচ্চা আর কিছুতেই বুকের দুধ মুখে নেয় না। দিলেই ঠেলে বের করে দেয় নাহলে কান্নাকাটি করে। ফলে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে নাফিসাকে আবার বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে আসতে হলো। সাথে জুটলো আত্মীয় স্বজনের টিটকারি আর ডাক্তারদের বকাঝকা।

কেস ২ঃ তুর্য অসম্ভব চঞ্চল একটা বাচ্চা। সারাদিন ছুটোছুটি করে। খাবার সময় হলেই তার বমি বমিভাব হয়, শুধু মাংস আর ভাতের বাইরে কিছু দিলেই থু করে ফেলে দেয় নাহলে বমি করে দেয়। সারাদিন না খাইয়ে রাখলেও খিদে লাগে না তার। যত শুকিয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে তত মায়ের কপালে খোঁটা জুটছে বাচ্চার যত্ন ঠিকমতো না নেয়ার।

কেস ৩ঃ ফাইজার পাঁচদিন ধরে জ্বর, গলাব্যথা, খেতে গেলেই বমি করে দিচ্ছে। ডাক্তারের কাছে এসেই মায়ের প্রথম কথা, বাচ্চা একদম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, রুচি নাই। খাবারের রুচির জন্য ঔষধ কি দেয়া যায়? মাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মায়ের যদি তীব্র জ্বর থাকতো তাহলে কি সে খেতে পারতো? ঔষধ দিলেই কি বাচ্চা অসুস্থ শরীরেও গপগপ করে খাবার খাবে?

আসলেই কি এগুলো সমস্যা বা রোগ নাকি মায়েদের মিথ্যা অভিযোগ যে বাচ্চা কিছুই খায় না৷ অন্য অনেকের মতো আমিও মনে করতাম, এসব মায়েদের অতিরিক্ত খাওয়ানোর চেষ্টা করার কুফল,আসলে কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু একটু বইপত্র, জার্নাল ঘেটে দেখলাম এটা আসলেই এক ধরনের অসুস্থতা বা Eating disorder। তাই নিয়ে আজকের আলোচনা।

Food aversion বা খাদ্যে তীব্র অনীহা আসলে কি?
দেখা গেছে, ২০-৫০% পর্যন্ত সুস্থ, স্বাভাবিক বাচ্চারও এই সমস্যা থাকতে পারে। বড়দের পাশাপাশি এমনকি নবজাতক শিশুদেরও এমন সমস্যা দেখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা এরজন্য দায়ী। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত খাওয়ানো, ভুলভাবে খাওয়ানো, খাবারে এলার্জি এবং ১৫% ক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণ হিসেবেও শিশুর খাবারে তীব্র অনীহা দেখা দিতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন বাচ্চার খাদ্যে অনীহা আছে?

১. নবজাতকের ক্ষেত্রে,
বুকের দুধ মুখে নিলেই বা খাওয়ানোর জন্য পজিশন নিলেই বাচ্চা অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করে বা বিরক্ত হতে থাকে। হাতপা ছোড়াছুড়ি করে দূরে সরে যায় বা মুখ দিয়ে নিপল ঠেলে মুখ থেকে সরিয়ে দেয়।
জাগ্রত অবস্থায় কোনভাবেই খাওয়ানো যায় না কিন্তু ঘুমন্ত ভাব হলেই আস্তে আস্তে মুখে দিলে খেতে থাকে।

২. একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, খাবার দেখলেই কান্না করা, বমি বমি ভাব করা, খাবার থু করে ফেলে দেয়া, খাবারের স্বাদ ভালো না বলা বা বাজে গন্ধ পাওয়া। নির্দিষ্ট খাবার ছাড়া অন্য কিছু দিলে বমিভাব বা বমি করা।

৩. খাদ্যে অনীহার সাথে ওজন ধীরে ধীরে কমতে থাকা, স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।

কেন হয় খাবারে তীব্র অনীহা?
১. জন্মের পর বা অসুস্থতার জন্য দীর্ঘ সময় নাকের নল দিয়ে খাবার দিলে বা মুখে খাবার বন্ধ থাকলে, কৃত্রিম শ্বাসের জন্য গলায় নল দেয়া থাকলে মুখে ও গলায় ঘা হলে বাচ্চা বিশেষ করে নবজাতকদের খাবার গেলা বা চোষার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

২. বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, খাবার বা অন্য কিছু শ্বাসনালীতে গিয়ে বিষম খেলে বা শ্বাসকষ্ট হলে পরবর্তীতে ভীতি থেকে খাদ্যে অনীহা তৈরী হয়। আবার মুখে বা জিহ্বায় ঘা থাকলে বা আঘাত পেলে, দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকলে বা কড়া এন্টিবায়োটিক বা কেমো পেলে জিহবায় সাদা পর্দার মতো ময়লা জমে বা ফাংগাস জমে। এসব ক্ষেত্রে বাচ্চা খাবারের স্বাদ না পাওয়ায় খাদ্যে অনীহা জন্মায়।
ফলে বাচ্চার খাবারের প্রতি ভীতি জন্মে , খেলে ব্যথা পায় বা গিলতে কষ্ট হলে অল্প খেয়ে আর খেতে চায় না।

৩. অনেক সময় মায়েরা বাড়তি খাবার তিনবেলা খাওয়ান সেই হিসেবে ভাবেন বাচ্চাকে তো কমই খাওয়াচ্ছেন কিন্তু এর বাইরে যে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন সেটাকে অনেকেই খাবার হিসেবে মনে করেন না। ফলে বুকের দুধ খেয়ে যে বাচ্চার পেট ভরে থাকলো, এরপর দিতে চাইলে বাড়তি খাবার বাচ্চা নাই খেতে চাইতে পারে,এটা তারা বুঝতে পারেন না । এটাকে কিন্তু তখন খাদ্যে অনীহা বলা যাবে না ।

আবার, সবার খাবারের চাহিদা এক রকম না। কারো তিন চামচ খেলেই পেট ভরে যায় আবার কারো এক প্লেটেও পেট ভরে না। কাজেই, আপনার সন্তানের খাবারের চাহিদাকে বুঝুন, খিদে লাগতে দিন এবং কখনোই জোর করবেন না।
খাদ্যে অনীহা মোকাবিলায় কি করবেন?

নবজাতক বা বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেঃ
১. মায়ের গায়ের চামড়ার সাথে বাচ্চাকে গা লাগিয়ে রাখুন ( Skin to skin contact)
২. আগে যেভাবে খাওয়াতেন সেভাবে না খাইয়ে অন্য কোনো পজিশনে খাওয়ান।
৩. কোনো ধরনের ফিডার, চুষনী, প্যাসিফায়ার দেয়া যাবে না। তবে দাত হওয়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বা মায়ের নিপলে ব্যথা থাকলে নিপল সিল্ড বা প্লাস্টিকের কভার নিপলের উপর দিয়ে চুষতে দেয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে জীবানুর আক্রমণ, মায়ের ব্রেস্টে ইনফেকশন বা বুকের দুধ খম পাওয়ার মতো সমস্যাগুলো হতে পারে।
৪. জাগা অবস্থায় না দিতে পারলে, প্রাথমিকভাবে ঘুমঘুম ভাব হলে দেয়ার চেষ্টা করবেন যেন নবজাতক টানা ৪-৫ ঘন্টা না খেয়ে থাকার মত অবস্থা না হয়। তবে সারাদিনে ২৪ ঘন্টায় বাচ্চাকে ১ বার অন্তত ১২ ঘন্টার টানা ঘুম দিতে হবে৷

বুকের দুধ না পেলে কি করবেন?
১. কোনো ফর্মুলা বা ফিডার দেয়ার কথা ভুলে যান( বুকের দুধ দিতে সমস্যা আছে এমন মায়েরা বাদে)।
২. প্রয়োজনে মা বেশী করে পানি, দুধ, তরল খাবার, গুড়ামাছ, সবজি, কালিজিরা খাবেন। বিশেষ করে বুকের দুধ দেয়ার আগেপরে ২ গ্লাস পানি খাবেন।
৩. বাচ্চার সাথে মায়েরও পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন আছে।
৪. দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার জন্য মা গান শুনতে পারেন, বই পড়বেন, গরম পানিতে গোসল নিতে পারেন।
৫. বুকের দুধ বাড়ানোর জন্য গরম সেক, ম্যাসাজ, পাম্পের মাধ্যমে কিছু দুধ বের করে নেয়া যেতে পারে।

বুকের দুধ বাড়ানোর একমাত্র উপায় মাকে সুস্থ ও টেনশন ফ্রি রাখা যা একমাত্র তার পরিবারের সাপোর্ট ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয় অথচ এইদিকটা আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খাদ্যে অনীহার সমাধানঃ
১. অসুস্থ, মুখে আঘাত বা ঘা সাময়িক সমস্য। এসব ক্ষেত্রে তরল খাবার বা অল্প অল্প করে বার বার খাওয়ানো, চামচে করে খাবার গিলতে দেয়া যেতে পারে।
২. দাঁত ব্রাশ করার সময় ২ বেলা জিহ্বাও ব্রাশ করে দিতে হবে যেন জিহ্বায় ময়লা না জমে।
৩. বাচ্চাকে খাবারে আগ্রহী করে তোলার জন্য খাবার তৈরির সময় বাচ্চাকেও সাথে নিন সাহায্য করার জন্য । তাকেও মতামত দিতে দিন।
৪. খাবার পরিবেশনের সময় খাবার ডিজাইন করা, ঘরবাড়ি, কার্টুন আকা, ছোট পশুপাখি তৈরী করা, খাবারগুলো বাচ্চা খেলনা হাঁড়িপাতিল বা থালাবাটিতে দেয়া, খাবার নিয়ে গল্প তৈরি করা ; এভাবে খাবার পরিবেশটা বাচ্চার জন্য আনন্দদায়ক করা যেতে পারে ভীতি দূর করার জন্য।
৫. মোবাইল টিভি বন্ধ করে ছড়াগান বা গল্পের মাধ্যমে বা পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্পগুজবের মাধ্যমে বাচ্চার আগ্রহ তৈরূ করতে পারেন খাবারে।
৬. বাচ্চাকে নিজহাতে খেতে উৎসাহিত করুন। বার বার খাওয়ার জন্য বিরক্ত না করে, টেবিলে খাবার রেখে আসুন ও বাচ্চাকে খিদে লাগলে নিজেই খাবার খুঁজে খেতে দিন।
৭. কখনোই জোর করবেন না বা চাহিদার অতিরিক্ত খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। তরল বা ব্লেন্ড করা খাবার নিরুৎসাহিত করুন, বাচ্চাকে চিবিয়ে খেতে উৎসাহিত করুন।
৮. আস্তে আস্তে করে খাবারের পরিমাণ ও সময় বাড়ান। একদুই চামচ ১০ মিনিট পর্যন্ত খেলো এরপর বন্ধ। আবার ৬-৭ চামচ ১৫-২০ মিনিট সময় ধরে খেলো। তবে আধা ঘণ্টার পর আর কোন খাবার দিবেন না। তাহলে আবার হজমে সমস্যা হবে।

চিকিৎসা কখন প্রয়োজন?
১. দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে, স্বাস্থ্য কমতে থাকলে সেভাবে চিকিৎসা করাতে হবে।
২. রক্তস্বল্পতা রোগ থাকলে আয়রন, ফলিক এসিড ও আয়রন যুক্ত খাবার যেমন মুরগির কলিজা, কাঁচা কলা, লাল শাক, রঙিন শাকসবজি খাওয়াতে হবে।
৩. আচরণগত সমস্যা বা অটিজমের লক্ষণ থাকলে কাউন্সেলিং ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হবে।

বাচ্চার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে, খাবারকে ভীতিকর কিছু ভাবতে দেয়া যাবেনা। বাচ্চাকে উৎসাহিত করুন তার নিজের খাদ্য তালিকা বাড়ানোর জন্য, প্রতিবার নতুন খাবারের জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন, খাবার দিয়ে গল্প তৈরী করতে দিন এবং কিছু দিন পর পর তার উন্নতিগুলো পর্যালোচনা করুন।
( Record> Reward > Relaxation > Review)
আগেরকার দিনে দশ বারোটা বাচ্চা নিয়ে যৌথ পরিবারে মায়েদের এত সময় ছিল না বাচ্চাদের খাবার নিয়ে ঝামেলা করার। তারপরও বাচ্চারা বড় হয়েছে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সন্তানদের সন্তানরা আজ বাবা মা হয়েছেন। এখন একটা বাচ্চা, একক সংসারেও যেন বাচ্চা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার শেষ নাই। দুধে আলতা রং হতে হবে, আপেলের মতো গাল হতে হবে, আইস্টাইনের মতো জ্ঞানী হতে হবে, বিল গেটসের মতো সফল হতে হবে, পড়ালেখায় টপার হতে হবে,নাচগান ছবি আঁকায় পারদর্শী হতে হবে, পাশের বাড়ির বাচ্চার থেকে এগিয়ে থাকতে হবে।

এজন্য চার্ট করে গুগল ঘেঁটে ভালো ভালো বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার বানিয়ে খাওয়াতে হবে যেভাবেই হোক। সবকিছুতেই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কি আসলেই শিশুকে মানুষ হয়ে গড়তে সাহায্য করছে নাকি অসুস্থ, অমানুষ বানাচ্ছে ?


ডাঃ লুনা পারভীন
শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ
ঢাকা শিশু হাসপাতাল

এই পাতাটি ৬৪৮বার পড়া হয়েছে

স্বাস্থ্য প্রবন্ধ



যোগাযোগ
প্যারামেডিকেল রোড
লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী
Email: info@rajdoc.com
Phone: +8801753226626